দৈনিক প্রথম সংবাদ

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের ৫ বছরের কারাদণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধে গুরুত্বপূর্ণ রায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিচারিক অধ্যায় হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতন ও অন্যান্য জঘন্য অপরাধের বিচার দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। এই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ে তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।মামলার পটভূমি১৯৭১ সালের জুলাই থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংগঠিত গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। তিনি তখন স্থানীয়ভাবে পাকিস্তানি সহযোগীদের সঙ্গে মিলে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ ছিল। বছরের পর বছর তদন্ত ও প্রমাণ উপস্থাপনের পর এই মামলা আদালতে আসে। মামলার প্রাথমিক শুনানিতে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। তবে তিনি আদালতের কাছে দোষ স্বীকার করে মানবতাবিরোধী অপরাধে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন জানান। আদালত সেই আবেদন বিবেচনা করে দৃশ্যত কম সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আদালতের রায় ঘোষণাসোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায়ের ৪৫৩ পৃষ্ঠার প্রথম অংশ পাঠ শুরু হয়। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি ছিলেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ছয় অধ্যায়ে বিভক্ত এই দীর্ঘ রায় ঘোষণায় অভিযুক্ত ব্যক্তির ভূমিকা, মামলার প্রমাণ, সাক্ষীর বয়ান ও তদন্ত প্রতিবেদন বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়।দুই ঘণ্টা দশ মিনিটের শুনানি শেষে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে বিচারপতি মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী রায়ের শেষ অংশ ঘোষণা করেন। আদালত বলেন, মামুন দোষ স্বীকার করে তদন্তে সহযোগিতা করায় সর্বোচ্চ সাজা নয়, বরং ৫ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এই রায়ে বলা হয়, তার স্বীকারোক্তি অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপনে সহায়ক হবে।অভিযোগ এবং প্রমাণমামলায় প্রধান অভিযোগ ছিল ১৯৭১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার। প্রসিকিউশন পক্ষ মোট ২২ জন স্বাক্ষী আদালতে হাজির করে। সাক্ষীরা বলেন, সেই সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের নির্দেশে কয়েকটি গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।তদন্তে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তিনি স্থানীয় সহযোগী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও সমর্থকদের টার্গেট করতে। তবে আদালত স্বীকার করে যে, মামুন সরাসরি শারীরিকভাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না বরং তিনি পুরো পরিকল্পনার অন্যতম সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছিলেন।রাজসাক্ষী হওয়ার প্রেক্ষাপটচৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন আদালতে জানান, তিনি অতীতে নিজের ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথ্য দিতে সম্মত হওয়ায় তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে বিবেচিত হন। তদন্ত সংস্থা জানায়, মামুন যে তথ্যগুলো দিয়েছেন, তা আরও অন্তত তিনটি মামলার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।রাজসাক্ষী হিসেবে দোষ স্বীকার করলেই যে মুক্তি মেলে না, সেটিও এই রায়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। আদালত মন্তব্য করে, “আসামির বক্তব্য ও সহযোগিতা বিবেচনা করা হলেও অপরাধের গুরুতর দিক উপেক্ষা করা যায় না।” তাই ৫ বছরের কারাদণ্ডই উপযুক্ত শাস্তি বলে বিবেচিত হয়।রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণরায়ে বিচারপতিরা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আত্মত্যাগের চূড়ান্ত উদাহরণ। সেই যুদ্ধের সময় যারা নিরপরাধ জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে, তাদের বিচার করা দেশের নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব। আদালত আরও উল্লেখ করে যে, বাংলাদেশ কোনো প্রতিশোধ নয়, বরং ন্যায়বিচারের পথেই এ ধরনের মামলার রায় ঘোষণা করে আসছে।রায়ে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধ রাষ্ট্রের ভিত্তি নষ্ট করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শহিদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই রায় ঘোষণা করা হলো।রায়ের তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়াএই রায়কে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করছেন। তারা মনে করেন, একজন সাবেক উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার দোষ স্বীকার করা ও আদালতের সহযোগিতা করা ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, এই রায় প্রমাণ করেছে যে যেকোনো অবস্থানে থাকা ব্যক্তির দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এটি সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়ার সফল প্রয়াস। সরকারি আইনি পরামর্শকরা মনে করেন, রাজসাক্ষী হিসেবে মামুনের দেওয়া তথ্য ভবিষ্যতে আরও অপরাধীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং বিচারকে ত্বরান্বিত করবে। সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধগুলোর বিচার শুধু আইনি নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। এই রায়ের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের সময়ে সংঘটিত নৃশংসতাগুলোর দায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন প্রজন্মকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে একদিকে অপরাধীদের জন্য আইনকে ভয়ের প্রতীক হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে, অন্যদিকে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কিছুটা হলেও ন্যায়বিচারের স্বাদ পাচ্ছে। একজন বিশ্লেষক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস শুধু রাজনীতি বা যুদ্ধের ইতিহাস নয়, এটি মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার ইতিহাসও। তাই এই রায় সেই মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার অংশ। ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট রাজসাক্ষী হিসেবে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের ভূমিকা ভবিষ্যতের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলাগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। এ রায়ের মাধ্যমে আদালত দেখিয়েছে, ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পথে সহযোগিতা করলেও অপরাধীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয় না। একই সঙ্গে এটি তদন্ত সংস্থার জন্যও একটি ইতিবাচক প্রেরণা হবে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা আশা প্রকাশ করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই রায়ে ভবিষ্যতের বিচার প্রক্রিয়ায় নতুন গতি আসবে। রাজসাক্ষীর স্বীকারোক্তি পরবর্তী তদন্তগুলোকে আরও সহজ করবে, যা বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের মামলার রায় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধবিরোধী বিচারব্যবস্থাকে নতুন দিক দিয়েছে। এটি প্রমাণ করেছে যে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, পদ বা মর্যাদা নির্বিশেষে সবাই জবাবদিহিতার আওতায় আসবে। ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়তো শাস্তির দিক থেকে সীমিত, কিন্তু এর নৈতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনেক গভীর। রায়ের মাধ্যমে আবারও প্রতিফলিত হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার, এবং একটি মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন। [1039]

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড

শিরোনাম